১৫ অগাস্টকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ইসলামী ছাত্রশিবির, ইসলামি ছাত্র আন্দোলনসহ ডানপন্থি-বামপন্থি ও প্রগতিশীল মিলে ৩৪টি ছাত্র সংগঠন।
সোমবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র-টিএসসি অডিটোরিয়ামে ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
মঙ্গলবার লিয়াজোঁ কমিটির তরফ থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ১৫ অগাস্টকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন না করার বিষয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। উপস্থিত সব ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধিরা এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে লিখিতভাবে একমত পোষণ করেন।
এদিকে মঙ্গলবার অন্তর্বর্তী সরকারের তরফে ১৫ অগাস্ট জাতীয় শোক দিবসের সাধারণ ছুটি বাতিলের ঘোষণা আসে। প্রধান উপদেষ্টা মুহম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এ ছুটি বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়।
তবে আওয়ামী লীগের নানা স্তর থেকে দিবসটি পালনে প্রস্তুতির কথা বলা হলেও দলের পক্ষে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য আসেনি।
৩৪ ছাত্র সংগঠনের বিজ্ঞপ্তিতে অভিযোগ করা হয়েছে, ‘১৫ অগাস্ট’কে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতীকে রূপান্তর করা হয়েছে। এই দিনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পুনরায় ‘সন্ত্রাসী ও জঙ্গি’ কর্মকাণ্ডের ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। তাই জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ও অভ্যুত্থান সংহত করতে ১৫ অগাস্টকে রাষ্ট্রীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করাটা সমীচীন নয়।
সভায় ছাত্রনেতারা জুলাই-অগাস্টকে বাংলাদেশের জনগণের শোক, সংহতি ও প্রতিরোধের মাস হিসেবে বর্ণনা করে তাদের বক্তব্য দেন।
ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ক্যাম্পাসে অবস্থান করতে দেওয়া হবে না জানিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জুলাই-অগাস্টে সংঘটিত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে সুসংহতকরণের লক্ষ্যে ন্যূনতম এক মাস বা পরিস্থিতি অনুযায়ী আরও বেশি সময় সব ছাত্রসংগঠন ক্যাম্পাসগুলোতে নিজেরা আলাদা করে কোনো কর্মসূচি দেবে না; বরং এ আন্দোলনের ব্যানারে ঐক্যবদ্ধভাবে গণ-অভ্যুত্থানের চেতনাকে রক্ষা করার জন্য এবং সকল ধরনের প্রতিবিপ্লব রুখে দেওয়ার জন্য লড়ে যাবে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ব্যানার ব্যবহার করে কোনো ছাত্র ক্যাম্পাসে বা অন্য কোথাও কারও ওপর নির্যাতন, নিপীড়ন, হুমকি কিংবা ট্যাগ-ব্লেইম দিতে পারবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়ে
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সভায় সিদ্ধান্ত হয়।
‘সন্ত্রাসী’ ছাত্রলীগের কোনো কর্মী বা নেতা ক্যাম্পাসে অবস্থান করতে পারবে না বলে সভায় সিদ্ধান্ত হয়।
সভায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেন লিয়াজোঁ কমিটির পক্ষে উপস্থিত ছিলেন মাহফুজ আব্দুল্লাহ, নাসির আব্দুল্লাহ ও আরিফুল ইসলাম আদীব।
সভায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা ও ছাত্রপ্রতিনিধি নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদও উপস্থিত ছিলেন।
সভায় অংশ নেওয়া ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে ছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন (রাগিব নাঈম), বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন (মুক্তি কাউন্সিল), বিপ্লবী ছাত্র যুব আন্দোলন, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (ইউপিডিএফ), বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (জেএসএস), বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ (নুর), বাংলাদেশ ছাত্রপক্ষ।
আরও ছিল ছাত্র আন্দোলন (এনডিএম), বিপ্লবী ছাত্রসংহতি, রাষ্ট্র সংস্কার ছাত্র আন্দোলন, ছাত্র অধিকার পরিষদ (রেজা কিবরিয়া), বাংলাদেশ খেলাফত ছাত্র মজলিস, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিস, গণতান্ত্রিক ছাত্রদল (এলডিপি), নাগরিক ছাত্র ঐক্য, জাগপা ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ ছাত্র ফোরাম (গণফোরাম-মন্টু), ভাসানী ছাত্র পরিষদ, জাতীয় ছাত্র সমাজ (কাজী জাফর), জাগপা ছাত্রলীগ (খন্দকার লুৎফর), ছাত্র জমিয়ত বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্র সমাজ, বাংলাদেশ ছাত্র মজলিস, বাংলাদেশ জাতীয় ছাত্রসমাজ, বাংলাদেশ ছাত্রমিশন, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল ও জুম লিটারেচার সোসাইটি।
ছাত্র ফ্রন্ট ও ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের ভিন্ন সুর
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটির সভায় মাহির শাহরিয়ার রেজার নেতৃত্বাধীন ছাত্র ইউনিয়ন ও ও বাহাউদ্দীন শুভর সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট উপস্থিত ছিল না বলে দাবি করা হচ্ছে।
মঙ্গলবার সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি মুক্তা ও সাধারণ সম্পাদক রাহয়ান এবং ছাত্র ইউনিয়ন (একাংশের) সভাপতি রেজা ও সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দীন এক যৌথ বিবৃতিতে ওই সভায় তারা উপস্থিত ছিলেন না বলে তথ্য দিয়েছেন।
তারা বলেন, ওই সভায় ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ অন্যান্য মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠনের উপস্থিতি সারা দেশের গণতন্ত্রকামী ছাত্র-জনতাকে হতবাক করেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে সংঘটিত অভ্যুত্থানে দীর্ঘ ১৬ বছরের আওয়ামী স্বৈরশাসনের অবসান হয়েছে।
তাদের ভাষ্য- এই অভ্যুত্থানে তাদের দুই সংগঠন সারা দেশে সর্বাত্মকভাবে অংশ নিয়েছি, আন্দোলন তরান্বিত করার চেষ্টা করেছিল। অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ছাত্রসমাজের করণীয় প্রশ্নে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ঐক্যের নামে ছাত্রশিবিরসহ বিভিন্ন মৌলবাদী সংগঠনের সমন্বয়ে পরিচালিত কোনো প্রক্রিয়ার সঙ্গে তারা যুক্ত নয়।
পূর্বাপর
গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ পুরো অগাস্ট মাস জুড়ে শোক পালনে নানা কর্মসূচির আয়োজন করত। এবারও সেরকম ঘোষণা ছিল। কিন্তু ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে চলে যান।
এরপর দেশের আওয়ামী লীগের কার্যালয় এবং বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের বাড়িতে হামলা, ভাংচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর করা হয় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য।
এ পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের অনেকে দেশ ছাড়েন। তৃনমূলের নেতাকর্মীদের অনেকে আত্মগোপনে চলে যান। ফলে অগাস্ট জুড়ে ঘোষিত শোকের মাসের কর্মসূচিগুলো আর হয়নি।
শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় রোববার রাতে ফেইসবুকে একটি ভিডিও বার্তা দিয়েছেন। সেখানে তিনি ১৫ অগাস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে সারাদেশে জাতীয় শোক দিবসের কর্মসূচি পালিত হত। ঢাকার পাশাপাশি বড় আয়োজন থাকত গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায়, সেখানেই বঙ্গবন্ধুর সমাধি।
টুঙ্গিপাড়া আওয়ামী লীগ এবারও জাতীয় শোক দিবস পালনে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ১৫ অগাস্ট সকালে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাজ ধারণ, বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, দোয়া ও মোনাজাত, আলোচনা সভা এবং দরিদ্রদের মাঝে খাবার বিতরণেন মত কর্মসূচি রয়েছে এর মধ্যে।
গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিএম শাহবুদ্দির আজম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে না পারলে নেতাকর্মীদের লংমার্চ করে ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে যাওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।”