কিশোরগঞ্জে সম্পদের স্বর্গ গড়েছেন হারুন



সাবেক ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা প্রধান হারুন অর রশিদ। ২০তম বিসিএসের মাধ্যমে পুলিশ ক্যাডারে ২০০০ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় পুলিশ বিভাগে চাকরি নেন তিনি। কিন্তু তার বাবা মো. হাসিদ ভূঁইয়া মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার বাবার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জাতীয় সংসদের তৎকালীন ডেপুটি স্পিকার মো. আবদুল হামিদের প্রভাবে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তিনি জায়গা পান বলে জানা গেছে। 


কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম  হারুন-অর-রশীদের। তার বাবার নাম আব্দুল হাসিদ ভূঞা। চার ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় হারুন। দ্বিতীয় জিয়াউর রহমান মাদকদ্রব্যের এসআই ও তৃতীয় জিল্লুর রহমান পুলিশের ইন্সপেক্টর হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। এ ছাড়া হারুনের প্রতিষ্ঠিত বিলাসবহুল ‘প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট’ এর এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ছোট ভাই শাহরিয়ার। 


হারুন কিশোরগঞ্জের আজিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং গুরুদয়াল সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সূর্যসেন হলের ২১৩ নম্বর রুমে থাকার সময়ে তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতিতে তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদের স্নেহভাজন হওয়ার কারণে সে সময় তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।


জানা যায়, ডিএমপির সাবেক ডিবি প্রধান হারুন তার গ্রামের বাড়িতে শত কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তুলেছেন প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট নামে অত্যাধুনিক ও বিলাসবহুল একটি রিসোর্ট। মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামে ৪০ একরেরও বেশি জায়গা নিয়ে রিসোর্টটি তৈরি করা হয়েছে। রিসোর্টটির প্রিমিয়াম স্যুটের প্রতিদিনের ভাড়া ২০ হাজার টাকা। সর্বনিম্ন ডিলাক্স রুমের ভাড়া প্রতিদিন ১০ হাজার টাকা।


এ ছাড়া সুপার ডিলাক্স রুমের ভাড়া ১২ হাজার টাকা। ২০২১ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর রিসোর্টটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। রিসোর্টের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন এবং রিসোর্ট উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের বড় ছেলে কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক। 


প্রেসিডেন্ট রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তার ছোট ভাই ডা. শাহরিয়ার। রিসোর্টটিতে হারুনের পরিবারের ৫ থেকে ৭ একর জায়গা রয়েছে। বাকি অন্তত ৩৫ একর জায়গা ছিল অন্যদের। এসব জায়গার মালিকদের দাম দেওয়ার কথা বলে হারুন রিসোর্টের জন্য জায়গা দখলে নেন। জায়গার মালিকদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষজন রয়েছেন। এসব জায়গার জন্য কেউই পুরো দাম পাননি বলে অভিযোগ রয়েছে। কেউ ১০ লাখের মধ্যে এক লাখ, কেউ ২০ লাখের মধ্যে ২ লাখ এমন হারে টাকা পেয়েছেন। জায়গার দাম না পাওয়ায় এখনো অন্তত ১০ থেকে ১২ জন তাদের জমি রেজিস্ট্রি করে দেননি। 


তাদেরই একজন মিঠামইন সদর ইউনিয়নের গিরীশপুর গ্রামের দিলীপ বণিক। তিনি জানান, হারুন রিসোর্ট করার কথা বলে তার এক একর ১০ শতাংশ জায়গা নিয়েছেন। জমির কোনো দরদামও নির্ধারণ করা হয়নি। তাকে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। অথচ জমির দাম হবে অন্তত ২০ লাখ টাকা। 


টাকা না পাওয়ায় জমি রেজিস্ট্রি করে দেননি জানিয়ে দিলীপ বণিক বলেন, আমার মতো এমন অন্তত ১২ জন রয়েছেন, যাদের নামমাত্র টাকা দিয়ে জমি রিসোর্ট করার জন্য হারুন নিয়ে গেছে। আমরা জমির দলিল দেইনি। রিসোর্টের জন্য নেয়া ১২ আনার মতো জায়গার দলিল হয়েছে, বাকি জমির দলিল হয়নি। 


দিলীপ বণিক বলেন, আমার জমির কাগজ ও দলিল রয়েছে। যেহেতু জমি বিক্রি করিনি তাই আমিই জমির মালিক।


এলাকাবাসী জানান, সাবেক ডিবি প্রধান হারুন সাবেক প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদের আশীর্বাদ এবং সহযোগিতায় চাকরি পাওয়ার পর থেকে শুরু করে পুলিশের বিভিন্ন উচ্চ পদে আসীন হতে পেরেছেন। মো. আবদুল হামিদ সে সময় প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করায় তাকে খুশি করতে দাপুটে পুলিশ অফিসার হারুন তার রিসোর্টের নাম দিয়েছেন ‘প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট’। ফলে নিজেদের তেমন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জায়গা না থাকলেও রিসোর্টের জন্য জায়গা নিতে বেগ পেতে হয়নি। 


রিসোর্টটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সময় সেখানে মাত্র একটি পুকুর ছিল। এখন চারপাশে গাছপালা, ডুপ্লেক্স কটেজ, কালচারাল সেন্টার, আউটডোরসহ নানা কারুকার্য সম্বলিত পাথরের বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করা হয়েছে। রয়েছে একটি চাইনিজ রেস্তরাঁ, শিশুপার্ক, ওয়াচ টাওয়ার ও লেকসহ নানা কিছু। সাবেক প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদসহ আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের মন্ত্রী-এমপি, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিচার বিভাগের কর্মকর্তা, চলচ্চিত্র জগতের তারকা এবং ভিআইপি ব্যক্তিরা বিলাসবহুল রিসোর্টটিতে সময় কাটিয়েছেন। 


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর থেকে রিসোর্টটিতে দর্শনার্থীদের প্রবেশ বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে রিসোর্টে বুকিং চালু রয়েছে।


এদিকে হারুনের নিজের, স্ত্রী-সন্তান ও স্বজনদের নামে-বেনামে কেনা হয়েছে ফ্ল্যাট। কিশোরগঞ্জ শহরের নীলগঞ্জ রোড, উকিলপাড়া এলাকায় তিন তলাবিশিষ্ট বড় ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে। সাত বছর আগে উকিলপাড়ায় নির্মাণ করা হয় একটি ফ্ল্যাট।


এদিকে ২০১১ সালের ৬ জুলাই সংসদ ভবনের সামনে তৎকালীন বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবেদীন ফারুককে পিটিয়ে দেশজুড়ে আলোচিত হন তৎকালীন ডিএমপির তেজগাঁও জোনের ডিসি (অতিরিক্ত উপ-কমিশনার) হারুন অর রশীদ। এ ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থা কুড়ান আলোচিত এই পুলিশ কর্মকর্তা।


হারুনের বাবার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদের বিষয়ে মিঠামইন উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোহাম্মদ আলী চৌধুরী বলেন, হারুনের বাবা আব্দুল হাসেম মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণই করেননি। হারুন যখন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নেতা, তখন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে দিয়ে তার বাবাকে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেন।