"উখিয়ার সাহিত্য প্রাণপুরুষ "

"উখিয়ার সাহিত্য প্রাণপুরুষ "
আজ ছিল আমার জীবনের এক বিশেষ দিন। এই দিনটিকে আরও অর্থবহ করতে আমি চেয়েছিলাম একজন প্রকৃত জ্ঞানতাপস, গুণী ও সৃষ্টিশীল মানুষের সান্নিধ্যে কাটাতে। তাই আজ বিকেলে সস্ত্রীক উপস্থিত হয়েছিলাম আমাদের উখিয়ার গর্ব, শ্রদ্ধেয় মাস্টার শাহ আলম স্যারের নিজ বাড়িতে। তাঁর সাথে দীর্ঘক্ষণ বসে কথা বলার, জীবনের গল্প শোনার এবং তাঁর অসাধারণ সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে জানার এক বিরল সুযোগ পেয়েছি। এই আনন্দঘন সময়ে আমার সঙ্গে ছিলেন প্রিয় বন্ধু, ব্যাংকার সঞ্জয় বড়ুয়া (অফিসার, সোনালী ব্যাংক বাংলাদেশ, কক্সবাজার শাখা)। এই লেখাটি লিখতে বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছেন মাস্টার শাহ আলম স্যার নিজে এবং তাঁর সুযোগ্য সন্তান, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কবি সিরাজুল কবির বুলবুল এর লেখা জীবনী থেকে নেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি। এমন একজন জ্ঞানী ও সদা হাসিখুশি মানুষের সান্নিধ্য আমার জন্য এক পরম প্রাপ্তি। শিক্ষার হাতেখড়ি থেকে জ্ঞানের মশাল হাতে: মাস্টার শাহ আলমের শিক্ষাজীবন শুরু হয় উখিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। হারিকেনের ক্ষীণ আলোয়, সীমিত সুযোগ-সুবিধার মধ্যেও তাঁর জ্ঞানার্জনের অদম্য ইচ্ছা আজকের প্রজন্মের কাছে এক নিঃশব্দ অনুপ্রেরণা। মেধা তালিকায় শীর্ষে থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেন। সেই সময়ে বিদ্যুৎ ছিল না, রাতের বেলা হারিকেনের আলোয় পড়াশোনা করে এগিয়ে গিয়েছেন। পরে চট্টগ্রাম সরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয় (পিটিআই) থেকে প্রশিক্ষণ এবং কুমিল্লা বোর্ড থেকে এসএসসি পাস করে নিজেকে শিক্ষকতার জন্য প্রস্তুত করেন। তাঁর কাছে শিক্ষকতা ছিল কেবল পেশা নয়, বরং এক মহৎ ব্রত। সাহিত্যের অফুরন্ত ভাণ্ডার ও নবীনদের আলোকবর্তিকা: শিক্ষকতার পাশাপাশি সাহিত্যচর্চা ছিল তাঁর জীবনের নিঃশ্বাসের মতো। প্রবন্ধ, কবিতা, নাটক, গল্প, উপন্যাস, ছড়া, জার্নাল, অনুবাদ, লোকগান — সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি নিপুণভাবে বিচরণ করেননি। তিনি শুধু নিজের জন্য লেখেননি; বরং উখিয়ার মতো মফস্বল এলাকায় ‘সাহিত্য কুটির’ নামে একটি সাহিত্য সংগঠন গড়ে তোলেন, যা নতুন প্রজন্মের লেখকদের সাহস ও অনুপ্রেরণার উৎস। তাঁর হাত ধরে উখিয়ার সাহিত্য অঙ্গন পেয়েছে নতুন মাত্রা, যার ফলে গড়ে উঠেছে অসংখ্য প্রতিভাবান সাহিত্যিক। তিনি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে উখিয়া সাহিত্য কুটির ও উখিয়া লোকশিল্পী পরিষদকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এছাড়া উখিয়া লেখক পরিষদ, উখিয়া প্রেস ক্লাব এবং কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তাঁর প্রকাশিত কিছু অনবদ্য সৃষ্টি: কাব্যগ্রন্থ: সবুজ পাতার রক্ত গোলাপ (তৃতীয় চোখ),পুথিকাব্যে জাতির পিতা (বাংলা একাডেমি),কবিতায় শেখ মুজিবুর (তৃতীয় চোখ),সাড়ে তিন হাত মাটির ঘর (তৃতীয় চোখ),গোলাপের বারমাসীতো বাংলার রূপ (পুথি) (তৃতীয় চোখ),রে মর হায় হায়রে (লোকগাথা),স্তুতিনামা (পুথি),বিলাপ (তৃতীয় চোখ),গোলাপের কাছাকাছি (কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমি), সোনালী ধানের কাব্য,রক্তের রং লাল (কাব্য) ক্ষুদ্র কাব্য: ১.মলকাবানু মনু মিয়ার প্রেম কাহিনী (পুঁথি) ২.যেভাবে স্বাধীনতার জন্ম (পুঁথি) উপন্যাস: মাথিনের প্রেম (কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমি),পরিবানু(ঋতুবর্ণ) প্রবন্ধ: উখিয়ার পীর আউলিয়া (জীবনী) (তৃতীয় চোখ),সম্মানা গ্রন্থ আমার (কাব্যকথা),বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা (যৌথ প্রকাশনা, কক্সবাজার বাংলা একাডেমি) নাটক: একটি তারা একটি গোলাপ,শুকনো ক্ষতে রক্ত,(নাটক),হাজেরার পিরীতি(কাব্যনাট্য) এছাড়াও তাঁর অনেক অপ্রকাশিত গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও গানের পাণ্ডুলিপি এখনও সাহিত্য ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে চলেছে। প্রকৃতি ও জীবনবোধের গভীরতা: মাস্টার শাহ আলম প্রকৃতির এক নিঃশর্ত প্রেমিক। মহেশখালীর মৈনাক পাহাড়ের চূড়ায় সূর্যোদয়ের দৃশ্য তাঁকে এতটাই বিমোহিত করেছিল যে, তাঁর লেখায় প্রকৃতির প্রভাব স্পষ্টভাবে দেখা যায়। জীবনের প্রতিটি বাঁকেই তিনি প্রকৃতি থেকে শক্তি ও প্রেরণা খুঁজে নিয়েছেন। পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিক অবদান: উখিয়া উপজেলার বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা,চারণ কবি,নাট্য-অভিনেতা মরহুম ফয়েজ আহম্মদ বাঙালির প্রথমা কন্যা রেজিয়া বেগমের সাথে শুভ বিবাহ হয়। তাঁদের সন্তানরা — কবি সিরাজুল কবির বুলবুল (বর্তমানে এনজিও কর্মকর্তা), হারুন আল রশীদ প্রকাশ এ আর হারুন (কক্সবাজার জেলার বরণ্য কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার), শামসাদ রেজা মুন্নি, এবং শায়লা শারমিন রানী (সরকারি শিক্ষক ও আবৃত্তি শিল্পী) — সবাই সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং নিজ নিজ ক্ষেত্রে আলোকিত ভূমিকা রাখছেন। মাস্টার শাহ আলম শুধু পরিবারে নয়, পুরো সমাজে একজন মেধাবী শিক্ষক ও সংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে পরিচিত। কক্সবাজার বেতারের তালিকাভুক্ত নাট্যকার, গীতিকার, আবৃত্তিকার ও উপস্থাপক হিসেবে গণমানুষের মনের খোরাক জুগিয়েছেন বহু বছর। অদম্য প্রাণশক্তি ও চলমান সৃষ্টিশীলতা: আজও মাস্টার শাহ আলম আমাদের মাঝে আছেন, আমাদের পথপ্রদর্শক হয়ে। বর্তমানে শারীরিক অসুস্থতা (লিভার সিরোসিস) নিয়ে লড়াই করলেও, তাঁর সৃষ্টির অগ্নিশিখা নিভে যায়নি। তিনি প্রমাণ করেছেন — শারীরিক সীমাবদ্ধতা কখনও মননের শক্তিকে থামিয়ে রাখতে পারে না। তিনি আমাদের উখিয়ার জীবন্ত কিংবদন্তি, আমাদের গর্ব। তাঁর সৃষ্টিশীলতা ও জীবনসংগ্রাম আমাদের শিক্ষা দেয়, প্রতিকূলতার মাঝেও কীভাবে এগিয়ে যেতে হয় এবং সমাজ ও সাহিত্যের জন্য নিজের সবটুকু উজাড় করে দিতে হয়।
তরুণ প্রজন্মের প্রতি আমার আহ্বান: আজকের প্রযুক্তিনির্ভর যুগে আমরা সহজেই সবকিছু পেতে চাই। কিন্তু আমাদের শেকড়, সংস্কৃতি ও সৃষ্টিশীলতার মূলে যে মানুষেরা, তাঁদের গুরুত্ব ভুলে গেলে চলবে না। মাস্টার শাহ আলমের মতো মানুষেরা আমাদের মনে করিয়ে দেন — মানুষের মেধা, শ্রম ও আবেগের শক্তি কতটা অসীম। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের তরুণ প্রজন্ম যেন পড়াশোনার পাশাপাশি সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সৃজনশীলতার জগতে নিজেদের জড়িয়ে রাখে। গ্রাম বাংলার পুথি পাঠ, কবিতা, নাটক, পালাগান, কবির গান — এসবের সাথেই আমাদের শেকড় জড়িয়ে আছে। এই ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা ও সমৃদ্ধ করা আমাদের দায়িত্ব। মাস্টার শাহ আলমের এই অদম্য পথচলা উখিয়ার সাহিত্য জগতকে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যাবে — এই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করি এবং তাঁর প্রতিটি সৃষ্টি আরও বেশি মানুষের হৃদয়ে পৌঁছাক — এই আমাদের সকলের একান্ত প্রত্যাশা। "উখিয়ার সাহিত্য প্রাণপুরুষ " উপস্থাপনায়, প্রভাষক শুভংকর বড়ুয়া পাতাবাড়ি, উখিয়া, কক্সবাজার তারিখ:০৫.০৭.২০২৫ রোজ :শনিবার