অন্তহীন অভিযোগ উখিয়া থানার ওসি আরিফ হোসেনের বিরুদ্ধে
Monday, July 28, 2025
শাহীন মাহমুদ রাসেল, কক্সবাজার
কক্সবাজারের উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আরিফ হোসেনের বিরুদ্ধে ঘুষ, দালালচক্র, মাদক কারবারিদের সঙ্গে আঁতাত ও মিথ্যা মামলা দিয়ে নিরীহ মানুষকে হয়রানির মতো একাধিক গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, উখিয়া থানা এখন আইন প্রয়োগের স্থানের চেয়ে বরং নিরীহদের আতঙ্ক আর অপরাধীদের নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত হয়েছে।
বিশ্বস্ত সূত্র ও একাধিক ভুক্তভোগীর বরাতে জানা গেছে, ওসি আরিফ দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই থানায় সক্রিয় হয়েছে একটি অসাধু সিন্ডিকেট। অভিযোগ রয়েছে, নির্দিষ্ট দালালদের মাধ্যমে থানার প্রতিটি মামলা ও অভিযোগ ‘ম্যানেজ’ করা হয়। অর্থ ছাড়া থানায় অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হয় না—এমন কথাও এখন সাধারণ মানুষের মুখে মুখে।
এছাড়া মাদক কারবারিদের কাছ থেকে মাসিক চাঁদা নেওয়া, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় থাকা অপরাধীদের রক্ষা করা এবং প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে সাজানো মামলা দেওয়ার ঘটনাও এখন ওপেন সিক্রেট। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে স্থানীয় সাংবাদিক তারেকুর রহমান পুলিশের আইজিপি, ডিআইজিসহ একাধিক সংস্থায় লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন।
তারেকের অভিযোগ, চিহ্নিত মাদক সম্রাট ‘চিয়ক ফরিদ’-এর বিরুদ্ধে সম্প্রতি কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই ফরিদ তার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। ফরিদের সন্দেহ—এসব সংবাদের পেছনে তথ্যদাতা ছিলেন তারেক। সেই ধারণা থেকে প্রতিহিংসায় উন্মত্ত হয়ে ফরিদ তাকে ফাঁসানোর ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠেন। এ সময় ফরিদের মাদক সিন্ডিকেটের অভ্যন্তরে মাদকের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে বিরোধে জড়ায় একাধিক পক্ষ। সংঘর্ষে মাদক কারবারি শাহ আলমগীর গুরুতর আহত হন। এই ঘটনাকে পুঁজি করে, ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে সাজানো কাহিনি তৈরি করেন ফরিদ। পরে ওসি আরিফ হোসেনকে পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে এই সাজানো মামলায় তারেককে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ৬ নম্বর আসামি করা হয়।
তারেক বলেন, ‘ওই সময় আমি কক্সবাজারে অবস্থান করছিলাম। ওসি নিজেও জানতেন, আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম না এবং এই ঘটনার সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তবুও তিনি পরিকল্পিতভাবে আমাকে ফাঁসিয়েছেন।’
তিনি আরও অভিযোগ করেন, ‘ওসি আরিফ হোসেন থানার দায়িত্ব পালনের নামে সাধারণ মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে, নিরীহদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে এবং দালালদের মাধ্যমে ঘুষ নিয়ে নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছেন।’
থানার ভেতরে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর প্রভাব দৃশ্যমান। ওসি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ইয়াবা কারবারিদের সঙ্গে আঁতাত, মাসিক মাসোয়ারা আদায়, দালাল সিন্ডিকেট গড়ে তোলা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু রয়েছে বলে দাবি স্থানীয়দের।
থ্যাংখালী ইউনিয়নে আয়োজিত এক মানববন্ধনে উখিয়া গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি হামিদুল হক বলেন, ‘উখিয়া থানায় ন্যায়বিচারের কোনো জায়গা নেই। দালাল ছাড়া থানায় কোনো অভিযোগ নেয় না পুলিশ। নিরীহ মানুষকে মামলা দিয়ে হয়রানি করে টাকা আদায় করা হচ্ছে।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, থ্যাংখালী এলাকার আলোচিত ‘মনিয়া গ্রুপ’ নামে এক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিরীহ মানুষের বিরুদ্ধে একাধিক মামলার চার্জশিট দিয়েছেন ওসি আরিফ হোসেন। এতে এলাকায় ক্ষোভ তৈরি হয়, এবং সেই ক্ষোভ রূপ নেয় বিক্ষোভে।
এছাড়া উখিয়ার হাজীরপাড়ায় মেহেদী হাসান নামে এক যুবকের মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। ঘটনার দিন ভুক্তভোগী সাংবাদিকদের জানান, হামলাকারীরা মুখ বাঁধা, ৪–৫ জনের বেশি ছিল না। কাউকে চিনতে পারিনি। তবুও ওসি আরিফ হোসেনের অনুমোদনে দায়ের হওয়া এজাহারে আসামি করা হয় ৮১ জনকে। স্থানীয়দের অভিযোগ, একটি প্রভাবশালী পক্ষের হয়ে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে ওসি মামলার দিক ঘুরিয়ে দেন। ফলে ৭০-৮০ জন নিরীহ ব্যক্তি হয়রানির শিকার হন।
একাধিক স্থানীয়ের ভাষ্য, থানায় গেলে কোনো অভিযোগ বা জিডি করতে গেলে আগে দালালের শরণাপন্ন হতে হয়। থানার ভেতরে ‘মাইম্যান’ নামে পরিচিত এই দালালচক্র বাদী-বিবাদী উভয়ের কাছ থেকেই টাকা নিয়ে পুলিশের মাধ্যমে আপস-মীমাংসার নামে নাটক সাজায়। যেই বেশি টাকা দেয়, রায় তার পক্ষেই হয়। এছাড়া ওসি আরিফ হোসেন প্রাথমিক তদন্ত ছাড়াই টাকার বিনিময়ে যেকোনো মামলা রেকর্ড করেন। কেউ নির্দোষ হওয়ার প্রমাণসহ বিষয়টি অবগত করলেও, তিনি দায় বাদির ঘাড়ে চাপিয়ে দেন এবং তদন্তে বাদ দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যান। এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই ন্যায়বিচার পাওয়ার আশায় থানার বদলে আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে ওসি মো. আরিফ হোসেন বলেন, ‘মামলার বাদী দাবি করেছে ওই ঘটনার সঙ্গে তারেক জড়িত, তাই তাকে আসামী করা হয়েছে। যদি তিনি নিরপরাধ হয়ে থাকেন, তাকে তদন্ত করে পরে বাদ দেওয়া হবে।’ এছাড়া তার বিরুদ্ধে ওঠা অন্যান্য অভিযোগগুলোও সত্য নয় বলে দাবি করেন ওসি।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের মুখপাত্র জসিম উদ্দিন বলেন, ‘ঘটনাটি তারেককে কেন্দ্র করে হয়েছে—এমনটাই আমাকে জানিয়েছেন ওসি। তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা হবে। অভিযোগের সত্যতা মিললে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সূত্র সময়ের কণ্ঠস্বর...